বিশ্বমঞ্চে কোনো নতুন লেখকের আবির্ভাব এর চেয়ে আর সশব্দে হতে পারে না, এমনি সে লেখক যদি বই-বাণিজ্যের এই পৃথিবীতে মিডিয়া ও অন্য সবার সব আনুকূল্য নিয়ে মঞ্চে ওঠেন, তা-ও। বাংলাদেশের এক অজপাড়াগাঁয়ের সন্তান জিয়া হায়দার রহমানের প্রথম উপন্যাসেই মঞ্চ ও গ্যালারির সব আলো যেভাবে একসঙ্গে জ্বলে উঠল, তাতে অবাক না হয়ে উপায় নেই। মাত্র দুই মাস হয় বেরিয়েছে তাঁর উপন্যাস ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো (বাংলায়: আমরা যা জানি তার আলোকে); আর এরই মধ্যে নিউইয়র্ক টাইমস পুরো আধা পৃষ্ঠা রিভিউ ছেপেছে বইটির, যেখানে আলোচক তাঁর লেখা শেষ করছেন এভাবে, ‘অদ্ভুত ও অত্যুজ্জ্বল এক উপন্যাস...আমি বরং অবাক হয়েছি বইটি আমার হাতের মধ্যে সশব্দে ফেটে পড়েনি দেখে।’ একটি উপন্যাস পাঠের অভিঘাত কতটা মারাত্মক হলে পাঠক ভাবতে পারেন যে বইটি তাঁর হাতে বোমার মতো বিস্ফোরিত হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল! এরপর আসি পৃথিবীর অন্যতম বনেদি সাহিত্য সাপ্তাহিকী দ্য নিউ ইয়র্কারে। এ পত্রিকার বইয়ের রিভিউগুলো সাধারণত ছোট আকারের, ১২০-১৩০ শব্দের মধ্যে হয়; সেখানে রহমানের বইটি জায়গা পেল পুরো চার পৃষ্ঠা। স্বয়ং জেমস উড, তর্কযোগ্যভাবে যিনি বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে খ্যাতিমান সাহিত্যবোদ্ধা, চার হাজার শব্দের এক চমৎকার নিবন্ধে এটিকে বললেন, ‘বুদ্ধিনির্ভর, আবেগবর্জিত...প্রতিটি পাতা ভরা আইডিয়া ও উসকানিতে...চোখ-ধাঁধানো’, এবং রহমানের সঙ্গে বারবার তুলনা টানলেন ভি এস নাইপল ও ডব্লিউ জি সেবাল্ডের। প্রসঙ্গক্রমে সেবাল্ড আমার প্রিয়তম লেখক; আমার ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র বইটি উৎসর্গ করেছিলাম তাঁকে।
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান এটিকে বলেছে ‘মহাকাব্যিক’; এরপর আরও কত পত্রিকা—কারকাস রিভিউ, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, গ্রান্টা, ভোগ ইত্যাদি। কীভাবে চোখের সামনে বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে অভিজাত ও প্রভাবশালী পরিমণ্ডলে জিয়া হায়দার রহমানের অভিষেক ঘটল, বলে শেষ করা যাবে না।
এর আগে আমাদের রঙের গায়ের চামড়া নিয়ে সম্ভবত সালমান রুশদি ও নাইপল ছাড়া অন্য কোনো লেখকের ভাগ্যে জোটেনি এ রকম দুর্দান্ত মঞ্চারোহণ। এ মুহূর্তে এই লেখকের ওপর আলোচনা চলছে তাঁর মাপ নিয়ে; অর্থাৎ কোন মাপের লেখক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা জাগাচ্ছেন তিনি, সে বিষয়ে। বইটি পড়ে এবং একে নিয়ে একাডেমিক আলোচনাগুলোতে চোখ বুলিয়ে আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে, সাহিত্যবোদ্ধারা সেবাল্ড কিংবা রুশদির মাপেরই কোনো লেখককে দেখছেন এই বাংলাদেশির মধ্যে।
এবার আসি উপন্যাস প্রসঙ্গে। ৫৫৫ পৃষ্ঠার দীর্ঘায়তন এ উপন্যাসের কাহিনি দানা বেঁধেছে ২০০৮ সালে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ধসের পরপরই; আর এর প্রিজমে ধরা আছে গত শতাব্দীর আধেকটা সময়। এর দুই নায়ক—একজন কথক, সে পাকিস্তানের এক বনেদি পরিবারের সন্তান, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে অর্থনৈতিক ধসের পরে এখন লন্ডনে দাঁড়িয়ে আছে চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে; অন্যজন জাফর, কথকেরই অক্সফোর্ডের অতীত সহপাঠী, সে এসেছে বাংলাদেশের এক দরিদ্র প্রেক্ষাপট থেকে। অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ডে পড়াশোনা শেষে ওয়াল স্ট্রিটে ব্যাংকার ও ঢাকায় মানবাধিকার আইনজীবীর পর্ব চুকিয়ে যুদ্ধ-পরবর্তী আফগানিস্তানে কাজ করেছে কিছুদিন; আর অভিজাত এক ব্রিটিশ মেয়ের সঙ্গে প্রেমপর্বের অন্তিমে আজ পুরো জীবনের প্রাপ্তি নিয়ে সে সন্দিহান এক চল্লিশ-ছোঁয়া যুবক। এই জাফরই একদিন হাজির হলো তার পুরোনো বন্ধুর লন্ডনের বাসায়, উষ্কখুষ্ক চুলে। জাফর কথককে বলে যাচ্ছে তার জীবনের গল্প, আর কথক টেপ রেকর্ডারে তুলছে সে কথা; জাফর তাকে পড়তে দিচ্ছে তার নোটবইগুলো, কথক তা থেকে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিচ্ছে তার উপন্যাসে। যেহেতু লেখক সংলাপে এখানে উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি, তাই আমরা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলছি কে এই ‘আমি’—জাফর না কথক নিজে?
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান এটিকে বলেছে ‘মহাকাব্যিক’; এরপর আরও কত পত্রিকা—কারকাস রিভিউ, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, গ্রান্টা, ভোগ ইত্যাদি। কীভাবে চোখের সামনে বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে অভিজাত ও প্রভাবশালী পরিমণ্ডলে জিয়া হায়দার রহমানের অভিষেক ঘটল, বলে শেষ করা যাবে না।
এর আগে আমাদের রঙের গায়ের চামড়া নিয়ে সম্ভবত সালমান রুশদি ও নাইপল ছাড়া অন্য কোনো লেখকের ভাগ্যে জোটেনি এ রকম দুর্দান্ত মঞ্চারোহণ। এ মুহূর্তে এই লেখকের ওপর আলোচনা চলছে তাঁর মাপ নিয়ে; অর্থাৎ কোন মাপের লেখক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা জাগাচ্ছেন তিনি, সে বিষয়ে। বইটি পড়ে এবং একে নিয়ে একাডেমিক আলোচনাগুলোতে চোখ বুলিয়ে আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে, সাহিত্যবোদ্ধারা সেবাল্ড কিংবা রুশদির মাপেরই কোনো লেখককে দেখছেন এই বাংলাদেশির মধ্যে।
এবার আসি উপন্যাস প্রসঙ্গে। ৫৫৫ পৃষ্ঠার দীর্ঘায়তন এ উপন্যাসের কাহিনি দানা বেঁধেছে ২০০৮ সালে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ধসের পরপরই; আর এর প্রিজমে ধরা আছে গত শতাব্দীর আধেকটা সময়। এর দুই নায়ক—একজন কথক, সে পাকিস্তানের এক বনেদি পরিবারের সন্তান, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে অর্থনৈতিক ধসের পরে এখন লন্ডনে দাঁড়িয়ে আছে চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে; অন্যজন জাফর, কথকেরই অক্সফোর্ডের অতীত সহপাঠী, সে এসেছে বাংলাদেশের এক দরিদ্র প্রেক্ষাপট থেকে। অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ডে পড়াশোনা শেষে ওয়াল স্ট্রিটে ব্যাংকার ও ঢাকায় মানবাধিকার আইনজীবীর পর্ব চুকিয়ে যুদ্ধ-পরবর্তী আফগানিস্তানে কাজ করেছে কিছুদিন; আর অভিজাত এক ব্রিটিশ মেয়ের সঙ্গে প্রেমপর্বের অন্তিমে আজ পুরো জীবনের প্রাপ্তি নিয়ে সে সন্দিহান এক চল্লিশ-ছোঁয়া যুবক। এই জাফরই একদিন হাজির হলো তার পুরোনো বন্ধুর লন্ডনের বাসায়, উষ্কখুষ্ক চুলে। জাফর কথককে বলে যাচ্ছে তার জীবনের গল্প, আর কথক টেপ রেকর্ডারে তুলছে সে কথা; জাফর তাকে পড়তে দিচ্ছে তার নোটবইগুলো, কথক তা থেকে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিচ্ছে তার উপন্যাসে। যেহেতু লেখক সংলাপে এখানে উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি, তাই আমরা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলছি কে এই ‘আমি’—জাফর না কথক নিজে?
কথকের জবানিতে আমরা শুনে যাচ্ছি পৃথিবীর মূল সত্যগুলোকে ধরতে ও বুঝতে চাওয়ার জাফরের
প্রয়াসের কাহিনি—তার বুকে জমে থাকা বিশাল ক্রোধের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। কী নিয়ে কথা বলছে না সে—দর্শন, ইমিগ্র্যান্ট জীবন, গণিত, যুদ্ধ, ওয়াল স্ট্রিটের ট্রেডিং, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, জাতি ও শ্রেণিবৈষম্য, এনজিও প্রোগ্রাম, অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ডের সর্বজ্ঞানী ধরনের সংকীর্ণ মানসিকতা, প্রেম ও সামাজিক শ্রেণিভেদ, বন্ধুত্ব ও প্রতারণা, মানবাধিকার কর্মীদের অহং, তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যা, বাখের সংগীত—রীতিমতো এনসাইক্লোপেডিক এক বিশ্বভ্রমণ, মেটাফিজিক্যাল ও আক্ষরিক—দুই অর্থেই। আমরা কোনো রোলার কোস্টারে চড়ার মতো করেই ঘুরে আসি নিউইয়র্ক, কাবুল, সিলেট, ইসলামাবাদ, দুবাই, প্রিন্সটন; বুঝতে পারি কোথায় যেন লুকিয়ে আছে এক বিশাল রহস্য—জাফর কি কোনো মানুষ খুন করেছিল? কথক কি অতীতে চরম এক বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল জাফরের সঙ্গে? জাফর কি গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িত ছিল আফগানিস্তানে? আর তার অদ্ভুত ব্লু-ব্লাড নামের বান্ধবী এমিলি হাম্পটন-উইভার্ন কেন জাফরকে তার চামড়ার রঙের কারণে বন্ধুদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখত, কেন এখন আফগানিস্তানে মানবকল্যাণ করতে আসা শিক্ষিত ডাকাতদের সঙ্গে অনেক অহংকার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই মেয়ে? আমরা দেখতে পাই, জাফর এখন বুঝতে পারছে কেন মেয়েটি তার জীবনে জাফরকে একবারও ‘সরি’ বলেনি! সে বুঝছে কেন ও কীভাবে পৃথিবীর এসব মূল সত্য আসলে পাথরেই লেখা, কিন্তু বুঝতে পারছে না কী কারণে এমনটাই হতে হবে পৃথিবীকে।
এ উপন্যাসের প্লট বর্ণনা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এই যে ওপরে যা কিছু লিখলাম, পড়ে এখনই মনে হচ্ছে কতটা অসত্য কথা লিখেছি আমি। এ উপন্যাসের মূল কথাও এটাই—আমরা যা সত্য বলে জানি, তা আদৌ কি সত্য? পৃথিবীর অভিজাত বিদ্যায়তনগুলোতে কয়েক বছর কাটিয়েই মানুষ কী করে ধারণা করে নেয়, সে সত্যিই জানে আফগানিস্তানে কী ঘটেছিল কিংবা ১৯৭১ সালে কেন আমেরিকা বাংলাদেশের জন্ম সমর্থন করেনি? জ্ঞান যদি সত্য হয়, তো জ্ঞান আসলে কী বস্তু? সত্য আসলে কোনটা—জ্ঞান নাকি আপনার জানাটুকু?
পুরো উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে অস্ট্রিয়ান গণিতবিদ কুর্ট গোডেলের বিখ্যাত ‘অসম্পূর্ণত্ব উপপাদ্য’; যে উপপাদ্য বলে, ‘যেকোনো সিস্টেমই অনুমান করে নিন না কেন, দেখবেন যে কিছু জিনিসকে দাবি করা হচ্ছে সত্য বলে, কিন্তু এটা প্রমাণ অসম্ভব যে এগুলো সত্য।’ উপন্যাসের শেষের আগের পাতায় আছে সাদা-কালো একটি ছবি। প্রিন্সটন
এ উপন্যাসের প্লট বর্ণনা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এই যে ওপরে যা কিছু লিখলাম, পড়ে এখনই মনে হচ্ছে কতটা অসত্য কথা লিখেছি আমি। এ উপন্যাসের মূল কথাও এটাই—আমরা যা সত্য বলে জানি, তা আদৌ কি সত্য? পৃথিবীর অভিজাত বিদ্যায়তনগুলোতে কয়েক বছর কাটিয়েই মানুষ কী করে ধারণা করে নেয়, সে সত্যিই জানে আফগানিস্তানে কী ঘটেছিল কিংবা ১৯৭১ সালে কেন আমেরিকা বাংলাদেশের জন্ম সমর্থন করেনি? জ্ঞান যদি সত্য হয়, তো জ্ঞান আসলে কী বস্তু? সত্য আসলে কোনটা—জ্ঞান নাকি আপনার জানাটুকু?
পুরো উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে অস্ট্রিয়ান গণিতবিদ কুর্ট গোডেলের বিখ্যাত ‘অসম্পূর্ণত্ব উপপাদ্য’; যে উপপাদ্য বলে, ‘যেকোনো সিস্টেমই অনুমান করে নিন না কেন, দেখবেন যে কিছু জিনিসকে দাবি করা হচ্ছে সত্য বলে, কিন্তু এটা প্রমাণ অসম্ভব যে এগুলো সত্য।’ উপন্যাসের শেষের আগের পাতায় আছে সাদা-কালো একটি ছবি। প্রিন্সটন
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে হেঁটে যাচ্ছেন আলবার্ট আইনস্টাইন ও কুর্ট গোডেল। ঝাপসা ওই ছবির দিকে তাকিয়ে, ৫৫৫ পৃষ্ঠার এ কাহিনি, এর ম্যাপ, ফুটনোট ইত্যাদি শেষ করে আপনার চোখে পানি এসে যাবে যখন, এক ঝলকের মতো হঠাৎই আপনি স্পষ্ট বুঝে ফেলবেন রহমান আসলে কী বলতে চাইছেন—জ্ঞান কারোরই নেই এবং অভিজাত সমাজগুলো আসলে জ্ঞান নয়, জ্ঞানের প্রলেপের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলে, সেভাবেই বিশ্ব শাসন করতে চায় তারা; গণিতই আসলে পৃথিবীর একমাত্র পক্ষপাতহীন, লোভ ও ক্রোধহীন জ্ঞান; জাতি ও শ্রেণিতে যারা ওপরে তারা যেভাবে মিথ্যাকে দেখে, সেটাই আজকের পৃথিবীর রাজনৈতিক সত্য; পুব আর পশ্চিমের ব্যবধান, সাদা ও কালো চামড়ার ব্যবধান—এসবই রূপকের (মেটাফর অর্থে) চক্করে পড়ে যাওয়া মানুষের কাছে কোনো ধর্মীয় ধরনের সত্য বলেই মানুষের বুকে এত ক্রোধ। জাফর এসব রূপক পেরিয়ে বাস করতে চেয়েছে বলেই সে এত অস্থির। ‘পুব’, ‘পশ্চিম’, ‘ঘর’, ‘প্রবাস’—প্রতিটি শব্দই তো এখন শক্তিশালী সব রূপক; আর যারা চাইছে এগুলো ভেঙে ফেলবে, তাদেরকে সেই রূপকের অন্তর্নিহিত শক্তি কেন্দ্র থেকে বহির্মুখে ছুড়ে দিয়ে যেন বলছে, যাবে কোথায়, আমার গতির মধ্যেই তো বাস করতে হবে তোমাকে! এমিলিও জাফরের কাছে এক জীবন্ত রূপক। ‘ঠিক যেসব কারণে এমিলিকে আমি ঘৃণা করি, ওই একই কারণে ভালোবাসি তাকে’, বলে জাফর। সিলেটও তার কাছে আরেক বিরাট রূপক। জাফরের কথায়, ‘না ওটা ঘর, না বিদেশ।’ উপন্যাসের এই সিলেট-অংশটিই সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী। এ পর্বেই লেখক বলেন, ‘বাংলাদেশকে যা আলাদা পরিচয় দিয়েছে তা বাঙালিত্ব নয়।’ তারপর এ দেশের তিন প্রধান নদীর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বললেন কীভাবে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা মিলে জন্ম হলো সবচেয়ে বাঙালি নদীটির, নাম যার মেঘনা। ঢাকার রেলস্টেশনে তাঁর উপলব্ধি: ‘হঠাৎ আমার ভেতরে প্রথম নাড়া পড়ল স্বগোত্রের বন্ধনের...অনুভব হলো আমি খুব মৌলিক কারণে একদল লোকের একটা অংশ। তারা সবাই দেখতে আমার মতো।’ সেবাল্ডের চরিত্রগুলোর মতোই জাফর কিংবা কথক যখন হাসছে, তখনো আপনি জানবেন যে তারা আসলে লড়াই করছে ভায়োলেন্স ও বিষাদের সঙ্গে; আর সেবাল্ডে ‘জ্ঞান’ যেখানে একান্ত ব্যক্তিগত কোনো বোঝা, রহমানে সে একই জ্ঞান একটা ‘সোশ্যাল অ্যাক্ট’; এবং, শেষে সেবাল্ডের চরিত্রেরা যেখানে স্মৃতিচারণার মধ্যে দিয়ে লড়ছে অসংখ্য মৃত মানুষের সঙ্গে, সেখানে রহমানের লড়াই মূলত সুট-বুট পরা, মানুষের মৃত্যুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করতে অভ্যস্ত করপোরেট দুনিয়ার বিরুদ্ধে; আর জাফরের ক্রোধের মূল কারণ, সে জেনে গেছে এই দুনিয়ার বাইরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে রূপকের সিলেট গোডেলের গণিততত্ত্বের মতোই প্রশ্নবিদ্ধ এক সত্য, অতএব তা জাফরের গন্তব্য হতে পারে না। সে আরও জেনে গেছে পৃথিবীতে নতুন বলে কিছু নেই; জাফরের ভাষায়, ‘যা কিছু নতুন, তা আছে আমাদের দৃষ্টির কিনারার দিকে, অর্থাৎ অন্ধকারে, দিগন্তরেখার নিচে, তাই নতুন কোনো কিছু আমরা যা জানি তার আলোক ব্যতীত আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়।’ উপন্যাসের নামের ব্যাখ্যাও আছে এই বাক্যের মধ্যেই।
জিয়া হায়দার রহমানের জটিল, গাণিতিক ও ইন্টেলকচুয়াল ভুবনে স্বাগতম আপনাকে, যেখানে আপনি নিশ্চিত অসংখ্য মিথ্যা কথা পড়বেন (লেখকও চাইছেন আপনি সেটাই পড়ুন), কিন্তু ঠিকই বুঝবেন যে আপনাকে এসব মিথ্যার আক্রমণের মধ্যে বাস করেও বিনয়ী ও শান্ত থাকতে বলছেন তিনি, ‘আমাদের মিশন শুধু একটাই...প্রশ্নগুলোর উন্মোচন, আর নদী সমুদ্রে যাচ্ছে কি না, তা না জেনেই নদীর কাছে যাওয়া এবং জীবনের ভৃত্য হিসেবে পৃথিবীতে নিজের জায়গাটুকু গ্রহণ করে নেওয়া।’
Source: Prothom-alo
Post a Comment
0 comments
Dear readers, after reading the Content please ask for advice and to provide constructive feedback Please Write Relevant Comment with Polite Language.Your comments inspired me to continue blogging. Your opinion much more valuable to me. Thank you.